
আফজাল হোসেন ইমন (৫০) ও সালাউদ্দিন প্রিন্স (২০)-বাবা-ছেলে ইয়াবা ব্যবসার কারণে সম্প্রতি খবরের শিরোনাম হয়েছেন। ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে বাবা ইমনকে ৮ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয় ছেলে প্রিন্সকে। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, পুরো পরিবারটিই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেন করত। সিআইডি ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি তদন্ত করছে।
ঘটনাস্থল
রাজধানী ঢাকার ৪৭১/সি, পশ্চিম শেওড়াপাড়া, মিরপুর তিন রুমের বিশাল বাসা। প্রতিটি রুম সাজানো দামি জিনিসপত্রে। ড্রইং রুমে শোভা পাচ্ছে ৫২ ইঞ্চি এলইডি কালার টেলিভিশন, নামি কোম্পানির দামি ফ্রিজ, দামি কাঠের নকশা করা বক্স খাট, কারুকার্য করা সোফা। নান্দনিকতার জন্য আরো রয়েছে দেশি-বিদেশি দামি আসবাবপত্র, রঙিন ঝলমলে ঝাড়বাতি ও মেঝেজুড়ে লাল কার্পেট। এককথায় বিলাসী জীবনের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার কোনো কিছুই নেই বাদ। চোখ ধাঁধানো বিলাসী এমন জীবনযাপন করেন মিরপুরের ইয়াবা ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন ইমন।
ইমনের পরিচয়
ইয়াবা ব্যবসায়ী ইমন চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার নীলকমল (মোল্লা বাড়ি) গ্রামের মৃত এম আমানুল্লাহর ছেলে। পড়াশুনা করেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় থাকতেন বিভিন্ন এলাকায়। সর্বশেষ বাসা ভাড়া নেন মিরপুর এলাকায়। তার দৃশ্যমান কোনো আয় ছিল না। তারপরও তিনি বিলাসী জীবনযাপন করতেন। প্রতি মাসে ২০ হাজারের উপরে বাসা ভাড়া দিতেন। সন্তানরা কোনো কিছু চাওয়া মাত্রই তা পূরণ করতেন। ইমন ইয়াবা ব্যবসার জন্য প্রতি মাসে কক্সবাজারে যেতেন। সঙ্গে প্রায়ই স্ত্রী ও সন্তানদের নিতেন। কিন্তু কীভাবে তার উত্থান, জেলে থাকায় সে বিষয়ে সিআইডি কিছু জানাতে পারেনি।
ইমন খুব চতুর ছিলেন। মুখভর্তি দাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে এলাকার মানুষের কাছে নামাজি সাজতেন। সব সময় মসজিদেই পড়ে থাকতেন। কিন্তু এর আড়ালে যে তিনি ইয়াবা ব্যবসা করতেন তা এলাকায় কেউ বুঝতেই পারতেন না।
সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, ইমন প্রায় আট থেকে দশ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রতি সপ্তাহে তিনি টেকনাফের ভুট্টো নামের এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাইকারি দরে ইয়াবা আনতেন এবং বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। পরে তা মিরপুর, শ্যাওড়াপাড়া, সাভার, গাজীপুর, বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করতেন তার বড় ছেলে সালাউদ্দিন প্রিন্স (২০), স্ত্রী সাদিয়া আফরোজ ও দশম শ্রেণি পড়ুয়া দুই মেয়ে। ইমন ইয়াবা ব্যবসার কারণে ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতেন। সর্বশেষ তিনি মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুরের পশ্চিম শ্যাওড়াপাড়ার বাসায় ওঠেন। ইমনের স্ত্রী সাদিয়া আফরোজের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে।
ইমনের পারিবারিক জীবনযাপন
দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে আফজাল হোসেন ইমনের পারিবারিক জীবন। যাদের প্রত্যেকের হাতে শোভা পায় বর্তমান যুগের দামি মোবাইল অপপোর আধুনিক মডেলসহ নামিদামি কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল, যার বাজার মূল্য ৪০-৬০ হাজার টাকা। বড় ছেলে ব্যবহার করেন ইয়ামাহা এফজেড, সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল, যার মূল্য আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। কয়েক মাস অন্তর বদলে যায় সেই মোটরসাইকেলও। কেবল তা-ই নয়, পরিবারের সদস্যদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রতি মাসে রয়েছে বিমানে কক্সবাজার ভ্রমণ। আর এ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ইমন পুরো পরিবারকেই ব্যবহার করেন তার অনৈতিক ব্যবসায়। যদিও তার পুরো পরিবার যে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত তা দেখেও বোঝার উপায় নেই। কারণ ইমন ও তার স্ত্রীর বেশভূষা দেখে এলাকার মানুষ তাদের মার্জিত ও পরহেজগার হিসেবে জানে। ইমনের স্ত্রী ও দুই মেয়ে পর্দা ছাড়া বাসা থেকে বের হন না।
ইমনের স্ত্রী ছবি : সংগৃহীত
যেভাবে ইমন ধরা পড়লেন
ইমন ও তার পুরো পরিবারের সদস্যরা যে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বিষয়টি সম্প্রতি এক মানি লন্ডারিং মামলায় সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে ইমনের স্ত্রী সাদিয়া আফরোজ সিআইডিকে জানিয়েছেন, এর আগে ইমন তিনবার গ্রেফতার হন। প্রত্যেকবারই গ্রেফতারের পর মাস খানেক জেল খাটার পর আবারও ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে আসেন। তারপর আবার শুরু করেন ব্যবসা। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর মাদক অধিদপ্তরের হাতে ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন ইমন। তারপর থেকে তিনি কারাগারে। ইমন গ্রেফতারের পর তার ছেলে প্রিন্স ও স্ত্রী এলাকার মানুষকে বলতেন, তিনি ভারতে বেড়াতে গেছেন।
ইমনের বড় ছেলে সালাউদ্দিন প্রিন্সকে গত ২ জানুয়ারি গ্রেফতার করে সিআইডি। ওই সময় মিরপুরের বিকাশ এজেন্ট ও ভিশন টেলিকমের স্বত্বাধিকারী স্বপনকেও গ্রেফতার করা হয়। এই স্বপন ইমনের ইয়াবা কেনার টাকা বিকাশে টেকনাফে পাঠাতেন। গত মঙ্গলবার স্বপনকে গ্রেফতারের পর তার কাছে থাকা ১০টি সচল মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। যেসব নম্বর থেকে নিয়মিত ইয়াবার অর্থ স্থানান্তর করা হতো, সে ধরনের ২৫০টির সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।
স্থানীয় ও এলাকাবাসীর বক্তব্য
দক্ষিণ সিটির ১৪ নং ওয়ার্ডের ৬ নং ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তফা কামাল হাওলাদার প্রিয়.কমকে বলেন, তিনি যে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী তা কেউ জানত না। তাছাড়া তাকে তেমনভাবে কেউ চিনতও না। কারণ তিনি ও তার পরিবারের কেউ কখনো কারো সাথে তেমন মিশতেন না।
এলাকাবাসী জানায়, ইমনের বড় ছেলে সালাউদ্দিনের ডাকনাম প্রিন্স। তাকে এলাকায় সবাই মডেল বয় হিসেবে চেনে। প্রিন্স মিরপুর বাঙলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার ছিল বন্ধু-বান্ধবের বিশাল কলেবর। এরই ফাঁকে দেখতেন বাবার ইয়াবা ব্যবসা। সে সব সময় ধনীর সন্তানের মতো চলাফেরা করত।
ইমন বর্তমানে যে বাসায় ভাড়া থাকেন সে বাড়ির দেখভালকারী বদরুল আলম খোকন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ইমন সাহেব গ্রেফতারের পরই তার পরিবারকে বাসা ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। তিনি যে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী, আগে জানলে তাকে বাসা ভাড়াই দিতাম না।’
প্রশাসনের বক্তব্য
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল-আজাদ প্রিয়.কমকে বলেন, ইমন ইয়াবার টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন। তার ছেলেকে গ্রেফতারের পর ইমনকে শোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। শিগগির তাকে ও তার ছেলেকে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হবে। রিমান্ডে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি আরো জানান, যেসব সিম জব্দ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতে গড়ে অন্তত ১০ হাজার টাকা করে মোট ২৫ লাখ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া চক্রটির কাছ থেকে ২১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ইমন প্রতিবার ধরা পড়ার পর জেল থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে ধরার পর মানি লন্ডারিংয়ের মতো শক্ত মামলা দেয়া হয়নি বলেই এই ব্যবসা থেকে তাকে বিরত রাখা যায়নি। মাদকের মামলায় মাস খানেক সাজা হওয়ার পরই সে বেরিয়ে আসে। তার পক্ষে তেমন সাক্ষী না থাকায় সাজাও হতো না। তবে এবার তাকে শক্তভাবেই ধরা হচ্ছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ইমন খুব চতুর। তার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ চক্রের অন্যান্য সদস্যকে গ্রেফতারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা নজরদারি রাখা হয়েছে।
পাঠকের মতামত